পৌষ পার্বণের সেকাল একাল

Sarmistha Ray || Post On > Jan 6 2023 ||

যৌথ পরিবারের সেই রান্নাঘর এখন শুধুই স্মৃতি। সংক্রান্তির দিন, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া কোনও ব্যস্ত অফিসযাত্রী কি আজও সন্ধান করেন প্রায় একটা হারিয়ে যাওয়া একটা ঘ্রাণ, যে সুগন্ধ একদিন ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিল বাঙালি-জীবনের সঙ্গে?বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন মেলায় খাবারের স্টলে পুলি-পিঠে বিক্রি হচ্ছে। বিক্রি হচ্ছে পাটিসাপ্টা, ভাপা পিঠেও। এই শীতকালের মেলা ছাড়াও অনেক জায়গায় ভাপা পিঠে বিক্রি হয়। মেলায় খাবারের স্টলে ঝাঁ-চকচকে এক্সপ্রো মেশিনের পাশে হয়তো কাচের পাত্রে রাখা থাকে পাটিসাপ্টা। তারপাশে হয়তো ভাপা পিঠে। কেমন অদ্ভুত লাগে! নতুন আর পুরনোর কী অদ্ভুত সহাবস্থান! স্টলে যে মহিলারা পিঠে তৈরি করেন, তাঁদের কখনও বলতে পারিনি— সংক্রান্তির দিন নিজের পরিবারের জন্য পিঠে তৈরি করেন তো?চাকরিজীবী মহিলাদের পৌষসংক্রান্তির দিনও প্রতিদিনের মতো কর্মস্থলে যেতে হয়। ইচ্ছে থাকলেও পিঠে তৈরির সেই আগ্রহটা আজ আর তেমন ভাবে তৈরি হয় না। হলেও সামান্য কয়েকটা পিঠে তৈরি করা মাত্র! তাকে পিঠে-উৎসব বলা যায় না!

একটা সময়ের পরে যখন আস্তে আস্তে এই ছবিটা যখন বদলাতে শুরু করল।তখন সবার প্রথমে আর্থসামাজিক বদলের ছোঁয়া লাগল মাল্টিসিটিগুলোয়। সেখান থেকে বিশ্বায়নের ঢেউ এসে পৌঁছল শহরে। তার প্রভাব পড়ল গ্রামজীবনেও। ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু করল যৌথপরিবার। পিঠে-পুলির চর্চা ক্রমশ অবসৃত হতে থাকল। পিঠে তৈরির মূল কারিগর যাঁরা, তাঁদের বিরাট একটা অংশ পিঠে-পর্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হল বাঙালির মধুমেহ রোগ বা ‘সুগার’ এবং ‘ডায়েট কন্ট্রোল’ আর দেহ ঠিক রাখার জন্যে মিষ্টির প্রতি অনীহা। সব মিলিয়ে শহর থেকে গ্রাম— অনেকটা ম্লান হয়ে গেল পৌষপার্বণের একান্নবর্তী উৎসবের আবহ।তখন ননস্টিক ফ্রাইং প্যান বা আধুনিক কোনও বাসনপত্রের জন্ম হয়নি। চালগুঁড়োও যে প্যাকেটবন্দি হতে পারে, সে ভাবনাও অকল্পনীয় ছিল। তা সত্ত্বেও কী নিঁখুত ভাবে তৈরি হত প্রত্যেকটা পাটিসাপটা আর অন্য পিঠেগুলো! উনুনে আগুনের আঁচ যেন গৃহিনীদের হাতের ছোঁয়ায় নিজে থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে যেত। একটা পাটিসাপটাও পুড়ে যেত না। তাওয়া আর খুন্তির যুগলবন্দিতে প্রত্যেকটাই কী দারুণ সুস্বাদু হয়ে উঠত!পৌষ সংক্রান্তির দিন দু-তিনটি ধানের শিষ বিনুনি করে 'আউনি বাউনি' তৈরি করা হয়| ধানের শিষ, মুলোফুল, সরষেফুল, গাঁদাফুল, আমপাতা ইত্যাদি বেঁধে দেওয়া হয়।।এই আউনি বাউনি আগেকার দিনে ধানের গোলা, ঢেঁকি, বাক্স-পেঁটরা-তোরঙ্গ ইত্যাদির উপরে এবং ঘরের খড়ের চালে গুঁজে দেওয়া হত।খুব সাবধানে তৈরি করা হত পুলিপিঠে। সেগুলো দুধে দিয়ে ফোটানোর সময় খুলে বা ফেটে গেলেই সর্বনাশ! সব পরিশ্রম তাহলে মাঠে মারা যাবে! কী উৎকণ্ঠাতেই না মা-কাকিমা-জেঠিমারা তাদের দিকে চেয়ে থাকতেন!পিঠের সঙ্গে সংক্রান্তির দিনে তৈরি হত নতুনগুড় দিয়ে পায়েসও। নতুন চাল আর গুড়ের সেই গন্ধ বাঙালির আরেক ঐতিহ্য! সংক্রান্তির সেই ঐতিহ্যপূর্ণ নৈবেদ্য বহু বাড়িতেই সর্বপ্রথমে গৃহদেবতাকে নিবেদন করা হত। পুলি-পিঠে-পায়েসের উৎসব সম্পূর্ণ হয়ে উঠত বাড়ির বয়স্ক মহিলা এবং নবীন মেয়েদের মেলবন্ধনে। রান্নাঘর সেদিন যেন একটা প্রথাবহির্ভুত স্কুল! সেখানে প্রবীণ মহিলার কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতেন নবীন মেয়েরা।সেইসব এখন অতিত তবুও স্মৃতি চারণ করতে বাঙালি বরাবর ই ভালবাসে,ভালবাসে সেই পুরনো আবেগ টাকে আঁকড়ে বাঁচতে ।

Last 0 Comments

Leave a reply

Write Comments